চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা
কারও মতে, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করেছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে তখন নবাব আলিবর্দির রাজত্বকাল। সে-সময়ে একবার রাজার কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। নজরানা দিতে অপারগ হলে রাজাকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফেরার সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে রাজা বুঝতে পারেন সেই বছরের মতো দুর্গাপুজো পেরিয়েছে। তখন রাজা খুব কষ্ট পান যে তিনি দুর্গাপুজো করতে পারলেন না।
কিন্তু সেই রাতেই দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে দেখা দেন এবং বলেন, পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে রাজা যেন তাঁর পুজোর আয়োজন করেন। এরপর ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজোর শুরু। কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণচন্দ্র নয়, কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক।এদিকে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেখাদেখি ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীও শুরু করলেন তৎকালীন ফরাসডাঙা বা অধুনা চন্দননগরে জগদ্ধাত্রীপুজো। তিনি চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপট্টিতে জগদ্ধাত্রীপুজোর সূচনা করেছিলেন। ইন্দ্রনারায়ণ তৎকালীন চাউলপট্টির সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হন।
এরপর বাংলাদেশের যশোরের ইন্দ্রনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে হিসেবরক্ষকের কাজে যুক্ত হন। এই চাউলপট্টি থেকেই তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ফরাসিদের সঙ্গে দারুণ ওঠাবসা ছিল তাঁর। চাউলপট্টি ছিল সেকালের বাংলার শস্যভাণ্ডার। লক্ষ্মীগঞ্জের বাজারে ছিল ১১৪টি ধানের গোলা, যার এক-একটিতে ৬০০০ মন ধান রাখা হত। শুধুমাত্র ১৭৩০ সালেই ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোট ব্যবসার পরিমাণ ছিল আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড। ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবার কাজেও থাকতেন ইন্দ্রনারায়ণ। তখন কৃষ্ণচন্দ্র ও ইন্দ্রনারায়ণ বন্ধু হয়ে ওঠেন। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রীপুজো দেখে প্রভাবিত হন তাঁরা।
অনুকরণেই চন্দননগরে তিনি এই পুজোর প্রবর্তন করেন। চন্দননগরে ইন্দ্রনারায়ণের বাড়িতেই সেই জগদ্ধাত্রী পুজো হত। চাউলপট্টির এই জগদ্ধাত্রীই আদি মা নামে সকলের কাছে পরিচিত। গঙ্গার তীরে শিবঘাটি ঘাটের পাশে, লক্ষ্মীগঞ্জবাজারের পিছনের দিকে স্থিত এই বাজারে চালের ব্যবসায়ীরাই পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এখানকার ব্যবসায়ীরা এই প্রাচীনতম পুজোটি করেন। চাউলপট্টি জগদ্ধাত্রীপুজোটি প্রায় ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। আদি মায়ের পুজো অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে করা হয়।
ষষ্ঠীর দিন থেকে শাড়ি ও সোনা-রুপোর গয়না দিয়ে সাজানো হয় মাকে। এত জাগ্রত এই আদি মা যে বহু মানুষ মানত হিসেবে সোনা-রুপো দান করেন বছর বছর আর সেইগুলি মাকে পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। সপ্তমীর দিনে সাতটি বিশাল মাপের থালায় নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। প্রসঙ্গত, সপ্তমী থেকে নবমী— প্রতিদিনই ছাগবলি, আখ, কুমড়ো বলি দেওয়ার রেওয়াজ সেই শুরু থেকে এখনও রয়েছে। এ ছাড়া অষ্টমীর দিন ১০৮টি রক্তপদ্ম নিবেদন করারও রীতি রয়েছে।
Image – https://www.jagadhatrionline.co.in/