একটি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ছবি
বলিউড মানেই গেরুয়াপন্থী। বা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার পক্ষে কথা বলা। যুগের পর যুগ ধরে হিন্দি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির তাবড় অভিনেতাদের আচরণে উঠে আসে এমনই ছবি। কখনও অক্ষয় কুমারকে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে, কখনও অনুপম খেরকে দেখা যায় নরেন্দ্র মোদির গুনগান করেই যেতে। একসময় কংগ্রেসের টিকিটে সাংসদ হওয়া অমিতাভ বচ্চনকে মোদী জমানায় দেখা যায় বিজেপির হয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করতে। এই সব উদাহরণের অর্থ? ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলার শিরদাঁড়া বলিউডের নেই।
কিন্তু শাহরুখ খান? বাদশাহকে নিঃসন্দেহে বলা যায় ‘দ্য লাস্ট অফ স্টার্স’। বিন্দুমাত্র কানেকশন ছাড়া যে ছেলেটা সিনেমা জগতে এসে ৩৫ বছর ধরে রাজত্ব করছে ইন্ডাস্ট্রিতে। যে ছেলেটা দিল্লির রামলীলা ময়দানে হনুমানের চরিত্রে অভিনয় করতো, সেই ছেলেটা আজ সারা ভারত, সারা বিশ্বের ‘কিং খান’। একমাত্র সেই যে পারে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, তা প্রমাণ করলো ‘জওয়ান’।
‘জওয়ান’কে একেবারে কমার্শিয়াল সিনেমা বলে আরও পাঁচটা ছবির বন্ধনীতে ফেলে দেওয়া ‘কার্ডিনাল সিন্’-এর থেকে কম কিছু হবেনা। এর পরতে-পরতে রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে আছে মুক্তোর মতো। এর পাশাপাশি ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অনেক করুণ ঘটনাবলী দর্শিত হয়েছে ছবিতে।
১) প্রথমেই দেশের কৃষকদের করুণ পরিস্থিতি ও পুঁজিপতিদের তেলা মাথায় সরকারের আরও তেল ঢালার প্রসঙ্গ ওঠে। দেখানো হয় এক গরীব কৃষককে কিরকম অত্যাচার করা হয় সামান্য কিছু ঋণের টাকা শোধ না করতে পারার জন্য। তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এরকম ১০ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেন গালভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া মন্ত্রীর আমলে। এদিকে একজন শিল্পপতির ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ স্রেফ মুকুব করে দেওয়া হয় কারণ তিনি শাসকদলের নেতাদের নির্বাচনী তহবিলে ‘মুক্তহস্তে দান’ করেন বলে। এই ঘটনার রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ২০০৯ সালে পাঞ্জাব সরকার প্রথম ঘোষণা করে যে যে কৃষকরা আত্মহত্যা করেছেন, তাদের ২ লক্ষ টাকা করে দেওয়া। আরও অনেক রাজ্য এরকম প্রকল্প শুরু করে। কর্ণাটক সরকার তো আবার ২ লক্ষ টাকার ‘প্রাইজ মানি’ বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করে দেয়। অর্থাৎ ঋণের জর্জরিত কৃষকদের কাছে মৃত্যুকে শ্রেয় হিসেবে তুলে ধরা হয় বেঁচে থেকে, লাঞ্ছণা সহ্য করে ঋণ শোধ করার থেকে। অন্যদিকে মোদি সরকারের ৮ বছরের ১২ লক্ষ কোটি টাকার লোন স্রেফ মুকুব করে দেওয়া হয়, ভারতীয় অর্থনীতি থেকে সেই টাকা বেমালুম হাওয়া হয়ে যায় কারণ এই ঋণের গৃহীতা কোনো কৃষক ছিলেন না, ছিলেন আদানী গোষ্ঠী, নীরব মোদী – মেহুল চোকসিদের মতো মানুষেরা, যারা দিনের শেষে গণতন্ত্রকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলে নির্বাচন জেতানোর টাকা দেন রাজনৈতিক দলগুলিকে।
২) গোরক্ষপুরের হাসপাতালে জাপানিজ এনসেফেলাইটিসে শিশুদের মৃত্যু এবং ডাঃ কাফিল খানকে সবার মনে আছে। যে কফিল খান অক্সিজেনের সিলিন্ডার জোগাড় করে বাচ্ছাদের প্রাণ বাঁচাতে এক উদ্যোগী হয়েছিলেন যখন যোগী আদিত্যনাথের নিজের কেন্দ্রের সরকারি আধিকারিকরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, সেই কফিল খানকে উল্টে জেল খাতায় উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। সেই ঘটনা তুলে ধরা হয় ডাঃ এরামের (সানিয়া মালহোত্রা) চরিত্রের মাধ্যমে।
৩) ভারতীয় সেনার জওয়ানদের খারাপ রাইফেলের ফলে মৃত্যুর একটি ঘটনা তুলে ধরা হয় একটি অংশে। এর সামঞ্জস্য টানা যায় ভারতের ইনসাস রাইফেলের সঙ্গে, তা বিক্রি করা হয়েছিল নেপাল সেনাকেও। ২০০৫ সালে মাওবাদীরা একটি নেপাল আর্মি বেস আক্রমণ করে। ১০ ঘন্টা টানা যুদ্ধের পর এই রাইফেল হঠাৎ কাজ করতে বন্ধ করে দেওয়ায় ৪৩জন নেপালি সেনা জওয়ান নিহত হন মাওবাদী জঙ্গীদের হাতে। পরে ভারতীয় সেনার একাধিক পরীক্ষায় বাজেভাবে অসফল হয় ইনসাস, এবং পরে তা একেবারে ফেলে দেওয়া হয়।
৪) যারা ইতিমধ্যেই ‘জওয়ান’ দেখে ফেলেছেন, তাঁদের মনে গেঁথে গেছে শাহরুখ খানের শেষের একটি মনোলগ, যেখানে তিনি দেশের মানুষের কাছে আবেদন করছেন যে, যারা দেশকে ভেঙে চুরমার করে ভোট ভিক্ষা করেন, তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে। প্রশ্ন করতে বলেছেন সকল রাজনৈতিক দলেদের যে তোমরা দেশের মানুষের জন্য কি করবে? চাকরি কি করে দেবে? অসুস্থ হয়ে গেলে কি করবে? দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি করবে? রাজনৈতিকভাবে ওয়াকিবহাল মানুষদের কাছে এটি সরাসরি বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করা হিসেবেই প্রদর্শিত হয়েছে।
৫) আর শেষে তো অবশ্যই বলার – যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নার্কোটিক্স ইন্সপেক্টর সমীর ওয়ানখেড়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিলো শাহরুখের ছেলে আরিয়ান খানকে – ছবিতে শাহরুখের ডায়লগ “বেটে কো হাত লাগানে সে পেহলে বাপ সে বাত কার।” এটাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া বলা বাতুলতা হবেনা।