ওয়াকফ বিলের কোন কোন বিষয়ে আপত্তি জানাচ্ছে বিরোধীরা
সোমবার ওয়াকফ বিল সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সরকারি আমলাদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলে জেপিসি বৈঠকে নতুন ওয়াকফ বিলের খসড়া নিয়ে তুমুল অশান্তির জেরে ভাঙা কাচে হাত কেটে পড়ল ছ’টি সেলাই।
শুধু কল্যাণ নন, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি (আপ), আরজেডি, ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর মতো বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের ওই বিলের বিরোধিতায়। তাদের অভিযোগ, ৪৪টি সংশোধনী এনে কেন্দ্র আসলে ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকারি কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে চাইছে। সংসদের দুই কক্ষে পাশ হলে এই আইনটির নতুন নাম হবে ‘ইউনিফায়েড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’।
এই বিল পাশ হলে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণা করার অধিকার ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকবে না। ওই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে জেলাশাসকদের হাতে। এর ফলে যাবতীয় ক্ষমতা জেলাশাসকের হাতে চলে যাবে। জেলাশাসক ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যানের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন। গুরুত্ব হারাবে ওয়াকফ বোর্ড।
ওয়াকফ বোর্ডে দু’জন মহিলার উপস্থিতির পাশাপাশি দু’জন অ-মুসলিম সদস্যকে বাধ্যতামূলক ভাবে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিরোধীদের বক্তব্য, অন্যান্য ধর্মের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিরা স্থান পান না। তা হলে ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিমদের স্থান দেওয়ার কী প্রয়োজন?
একমাত্র যাঁরা মুসলিম এবং যাঁরা শেষ পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করে চলেছেন তাঁরাই ওয়াকফ বোর্ডকে সম্পত্তি দান করতে পারবেন। কিন্তু কেউ যদি সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তা হলে তাঁকে দানের জন্য পাঁচ বছর কেন অপেক্ষা করতে হবে? এটা কি ধর্মাধিকারে হাত দেওয়া নয়?
হিন্দু মন্দিরগুলির মতোই ওয়াকফ বোর্ডকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ বিধিবদ্ধ সংস্থা” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই যুক্তিতেই এই নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে বিরোধীদের যুক্তি, ওয়াকফ বোর্ডের মতো বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরগুলি যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষ বিধিবদ্ধ “ সংস্থা’ হয়, তা হলে পুরীর মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে কেন?
বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ও হট্টগোলের মধ্যেই গত ৮ই অগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। বিলটি ‘অসাংবিধানিক এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী’ বলে অভিযোগ তুলে তখনই বিরোধীরা একযোগে তা নিয়ে আপত্তি জানান। দীর্ঘ বিতর্কের শেষে ঐকমত্যের লক্ষ্যে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি)-র কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পালের নেতৃত্বাধীন সেই সাত সদস্যের জেপিসিতে শাসক শিবিরের সাংসদ সাত জন। অর্থাৎ, বিরোধীদের আপত্তি তোয়াক্কা না করে একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে জেপিসি।
চলতি মাসে সেই জেপিসিতে বক্তব্য পেশ করতে এসেছিলেন অশ্বিনী উপাধ্যায়, বিষ্ণুশঙ্কর জৈনের মতো আইনজীবী, যারা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় থাকা ‘সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করে থাকেন। সঙ্ঘ পরিবারের ওই সদস্যেরা কেন জেপিসির বৈঠকে তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন কল্যাণ ব্যানার্জি। তারপর মঙ্গলবার, বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের একটি প্রস্তাব ঘিরে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয় শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদের। সেখান থেকেই এই অশান্তির সূত্রপাত।
ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা প্রসঙ্গে মুসলিম সংগঠনগুলির বক্তব্য, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল আনছে কেন্দ্র। জমিয়তে ইসলামি হিন্দ এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো মুসলিম সংগঠনগুলির মতে, গেরুয়া শিবির দীর্ঘ সময় ধরেই দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করার জন্য তড়িঘড়ি পাশ করাতে চাইছে সংশোধনী বিল। যদিও কেন্দ্রের যুক্তি, খোদ মুসলিম সমাজের গরিব এবং মহিলারা নিজেরাই নাকি এত দিন ওয়াকফ আইন সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সালে পাশ হয়েছিল প্রথম ওয়াকফ আইন। ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইনে সংশোধনী এনে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। তার পর থেকেই বিজেপির তরফে বার বার প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার’ নিয়ে।