থিমের ভিড়েও অম্লান শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর সাবেকিয়ানা
দুর্গাপুজোয় থিমের ভিড়ে আজও স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। শহরের অলিগলিতে থিমের পুজো দেখতে যেমন মানুষ ভিড় করেন, তেমনই শোভাবাজারের ঠাকুরদালানেও তিল ধারণের জায়গা মেলে না পুজোর পাঁচ দিন। সাবেকিআনাই এই পুজোর মূল আকর্ষণ। পলাশিতে ইংরেজদের জয়ের বছরেই শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ধুমধাম করে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। পুত্রসন্তান না হওয়ায় ১৭৬৭-’৬৮ সাল নাগাদ রাজা নবকৃষ্ণ তাঁর নিজের ভাইয়ের পুত্রকে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই গোপীমোহন দেবের পুত্র রাধাকান্তের নামেই পরিচিত শোভাবাজার রাজপরিবারের ‘বড় বাড়ি’।কয়েক বছর পরে রাজা নবকৃষ্ণের পুত্রসন্তান হয়। তখন তাঁর বয়স ৪৩ বছর। রাজার পুত্র রাজকৃষ্ণ বড় হলে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গোৎসব আলাদা হয়ে যায়। দুই বাড়িতে আলাদা করে পুজোর রেওয়াজ তৈরি হয়।
রাজকৃষ্ণের নামে পরিচিতি পায় রাজপরিবারের ‘ছোট বাড়ি’।রাধাকান্তের বাড়িতে রথের দিন ও রাজকৃষ্ণের বাড়িতে উলটোরথের দিন কাঠামো পুজো করে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। দু’বাড়িতেই ডাকের সাজের একচালার সাবেকি মূর্তি। রাধাকান্ত দেবের বাড়ির প্রতিমার সিংহটি সাদা রঙের ঘোড়ামুখো সিংহ, যাকে বলে নরসিংহ। মহিষাসুর সবুজ বর্ণের। রাজকৃষ্ণদেবের বাড়ির প্রতিমার সিংহটি স্টিলরঙা ও মহিষাসুরের রং সবুজ। রাজকৃষ্ণ দেবের বাড়ির প্রতিমার সামনে সার দিয়ে বেশ কয়েকটা জরির সুতো ঝোলানো থাকে। মা ঘরের মেয়ে তাই চিকের আড়ালে থাকেন। বাইরের মানুষ যাতে মাকে সরাসরি বা না-দেখতে পায়, সেইজন্য এই ব্যবস্থা।দুর্গানবমীর ঠিক আগের নবমীতে বোধন হয়। বোধনের দিন থেকে প্রত্যেকটি দিন ১৫ জন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত চণ্ডী, রামায়ণ ও অন্য বহু শাস্ত্রপাঠ করেন। সপ্তমীর সকালে একটা রুপোর ছাতা মাথায় নিয়ে নবপত্রিকাকে বাগবাজারের ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না, আতপচাল, ফল, মিষ্টি দই, দেবীকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। একসময় বাড়িতে ভিয়েন বসত, তৈরি হত নানারকমের মিষ্টি। সন্ধিক্ষণের পুজো আজও নিষ্ঠার সঙ্গে হয়। আগে সন্ধিপুজোর সময় বন্দুক ফাটানো হত। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জন। পিতৃ আলয় ছেড়ে মা দুর্গা শ্বশুরালয় যাত্রা করার আগে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয় রুপোর থালায়। সোনার সিঁদুর কৌটো, আতপ চাল, ধান, দূর্বা ও গিনি দিয়ে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়। আগে বিসর্জনের সময় নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত স্বর্গে গিয়ে মায়ের আগমনবার্তা মহাদেবকে পাঠানোর জন্য।